
২৪ জানুয়ারি গণঅভ্যুত্থান দিবস
আসাদদের রক্ত বেয়ে আসে স্বাধীনতা
কড়া নজর প্রতিবেদন –
…..মায়ের উঠোন ছেড়ে এখন সে-শার্ট/শহরের প্রধান সড়কে/কারখানার চিমনি-চূড়োয়/উড়ছে, উড়ছে অবিরাম/আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা/আমাদের হৃদয়ের রৌদ্র-ঝলসিত প্রতিধ্বনিময় মাঠে,/চৈতন্যের প্রতিটি মোর্চায়।/সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখন্ড বস্ত্র মানবিক ;/আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা। – শামসুর রাহমান ।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার, বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা ও ছাত্র সমাজের ১১ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে ১৯৬৯ সালের ১৭ জানুয়ারি থেকে সারা দেশ ফুঁসে ওঠে। পুলিশ ও ইপিআর’র নির্যাতন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্রতা লঙ্ঘনের প্রতিবাদে ২০ জানুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম কমিটি কর্মসূচি দেয়। কর্মসূচি প্রতিহত করতে প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে। ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিলসহকারে রাজপথে পা পাড়ালে পুলিশ হামলা চালায়। এদিন মিছিলে পুলিশের গুলিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসাদুজ্জামান মৃত্যুবরণ করলে গণজাগরণের বিস্ফোরণ ঘটে। দাবানলের মতো আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে।
২৪ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে নব কুমার ইনস্টিটিউটে নবম শ্রেণীর ছাত্র মতিউর এবং ছুরিকাঘাতে রুস্তম নিহত হলে তীব্র আন্দোলনের মুখে ঢাকার পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সংগ্রামী জনতা সচিবালয়ের দেয়াল ভেঙে আগুন লাগিয়ে দেয়। আগুন দেওয়া হয় সরকারের দালাল মন্ত্রী-এমপিদের বাড়িঘরে, এমনকি দৈনিক পাকিস্তান ও পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকা দুটিতেও। জনগণ আইয়ুব গেটের নাম পরিবর্তন করে রাখে আসাদ গেট।
১৭ থেকে ২৪ জানুয়ারি গণবিস্ফোরণে ঢাকা ও রাজশাহীতে আসাদ, রুস্তম, মনির, মতিউর, ড. জোহা নিহত হন। পরের বছর থেকে ২৪ জানুয়ারি গণঅভ্যুত্থান দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছে।
বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ৬ দফা দাবির মুখে পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক শাসক আইয়ুব খান বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি হুমকি দিয়ে বলেন, ৬ দফা নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে অস্ত্রের ভাষায় জবাব দেওয়া হবে। এদিকে ৬ দফা কর্মসূচি জনগণের মাঝে পৌঁছে দেয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা সমগ্র বাংলা সফর করেন এবং ৬ দফাকে বাঙালির বাঁচার দাবি হিসেবে অভিহিত করেন।
১৯৬৬ সালের ১৩ মে আওয়ামী লীগ আয়োজিত পল্টনের এক জনসভায় ৭ জুন হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। জুন মাসব্যাপি ৬ দফা প্রচারে বিপুল কর্মসূচি নেয়া হয়। ৭ জুন তেজগাঁওয়ে বেঙ্গল বেভারেজের শ্রমিক মনু মিয়া গুলিতে শহীদ হন। এতে বিক্ষোভের প্রচন্ডতা আরো বেড়ে যায়। আজাদ এনামেল অ্যালুমিনিয়াম কারখানার শ্রমিক আবুল হোসেন ইপিআরের গুলিতে শহীদ হন। একই দিন নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশনের কাছে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন ৬ জন শ্রমিক। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সন্ধ্যায় কারফিউ জারি করা হয়। হাজার হাজার আন্দোলনকারী মানুষ গ্রেপ্তার হয়। বহু জায়গায় জনতা গ্রেপ্তারকৃতদের ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। ৬ দফাভিত্তিক আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। শহীদের রক্তে আন্দোলনের নতুন মাত্রা গড়ে ওঠে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয় শ্রমজীবী-মেহনতি মানুষের আন্দোলন।
স্বায়ত্তশাসনের ৬ দফা নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান যখন এগিয়ে যাচ্ছিলেন ১৯৬৬ সালের ৮ মে গভীর রাতে তিনিসহ অন্য নেতারা আটক হন। ২০ মাস কারারুদ্ধ রাখার পর ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তির আদেশ দিলেও ১৯৬৮ সালের ১১ এপ্রিল এক সরকারি ঘোষণার মাধ্যমে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ এনে পাকিস্তান সরকার একটি মামলা দায়ের করে। মামলার শিরোনাম ‘পাকিস্তান রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য’। এতে এক নম্বর আসামি শেখ মুজিবুর রহমান। দেশ-বিদেশে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এর নাম দেওয়া হয় ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’। তবে বাংলার মানুষ এর নাম দেয় ‘ইসলামাবাদ ষড়যন্ত্র মামলা’। ১৯৬৭ সালের নভেম্বর মাস থেকে মামলার সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এনে শত শত বাঙালিকে গ্রেপ্তার করা হয়। আর ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন থেকে ঢাকার ক্যান্টমেন্ট এলাকায় স্থাপিত হয় বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। প্রহসনমূলক বিচার শুরু হয় সেখানে।
বিক্ষুব্ধ জনতা মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সোচ্চার হয়ে ওঠে। গণ-অভ্যূত্থানের অংশ নেওয়ার ফলে পাকিস্তানি আমলা, পুলিশ ও মিলিটারি সম্পর্কে জনসাধারণের মাঝে যে ভীতি ছিল, তা অনেকটা হ্রাস পায়। এ ছাড়া গ্রাম ও শহরাঞ্চলে শ্রেণী চেতনার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটে। পাশাপাশি ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে আলাদা রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি পায়, যা একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করার মতো পরিপুষ্ট হয়ে ওঠে।#