
দেশ – উত্তাল। ১৯৭১ এ যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। এমন সময় প্রায় প্রতিদিনই জাহানারা ইমামের সাথে দু’ছেলের তর্ক হত যুদ্ধে যাওয়া নিয়ে। এর মধ্যে রুমীর স্কলারশিপ হয়ে যায়। কিন্তু সেসময় স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে যাওয়ার চিন্তা রুমির মাথায় একদমই ছিল না। তার চােখে ছিল মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন, দেশ স্বাধীন করার স্বপ্ন। একটা সময় জাহানারা ইমাম তাকে যুদ্ধে যাবার অনুমতি দেন। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তাঁর ছেলেকে যুদ্ধে যাবার অনুমতি দেয়ার সময় বলেছিলেন, “যা তোকে দেশের জন্য কোরবানী করে দিলাম”।
শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ২৬তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাসপাতালে মারা যান।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষের কাছে জাহানারা ইমাম দেশপ্রেম, ত্যাগ ও সংগ্রামের এক অনন্য প্রেরণার উৎস হিসেবে আজও অবিস্মরণীয়।
দেশ – উত্তাল। ১৯৭১ এ যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। এমন সময় প্রায় প্রতিদিনই জাহানারা ইমামের সাথে দু’ছেলের তর্ক হত যুদ্ধে যাওয়া নিয়ে। এর মধ্যে রুমীর স্কলারশিপ হয়ে যায়। কিন্তু সেসময় স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে যাওয়ার চিন্তা রুমির মাথায় একদমই ছিল না। তার চােখে ছিল মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন, দেশ স্বাধীন করার স্বপ্ন। একটা সময় জাহানারা ইমাম তাকে যুদ্ধে যাবার অনুমতি দেন। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তাঁর ছেলেকে যুদ্ধে যাবার অনুমতি দেয়ার সময় বলেছিলেন, “যা তোকে দেশের জন্য কোরবানী করে দিলাম”।
মুক্তিযুদ্ধে তার ছেলে রুমী শহীদ হন, স্বামী শরিফ ইমামও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অসুস্থ হয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা যান। বিজয় লাভের পর রুমীর বন্ধুরা জাহানারা ইমামকে সব মুক্তিযোদ্ধার মা হিসেবে বরণ করে নেন। এক সন্তান হারিয়ে সারাদেশের সব মুক্তিযোদ্ধার জননী হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
রুমী ও তার সঙ্গীদের একজন সহযোদ্ধা হয়ে ওঠেন জাহানারা ইমাম। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাঁর সন্তান রুমী ও সঙ্গী মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও খাদ্য দেয়া, অস্ত্র আনা নেয়া ও যুদ্ধক্ষেত্রে তা পৌঁছে দেয়া ইত্যাদি ছিল তার মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধান ভূমিকা। যুদ্ধের ফাঁকে রুমি বাসায় আসতো। যুদ্ধের বিবরণ শোনাত তাঁর মাকে। যে রুমি গ্লাসে একটু ময়লা দেখলে পানি পান করতো না, সেই রুমি যুদ্ধে গিয়ে পোকা খাওয়া রুটি খেত। এসব ঘটনা শুনতে শুনতে জাহানারা ইমামের চোখ অশ্রুতে ভরে যেত। এভাবেই ‘৭১ এর সেই উত্তাল দিনগুলো কাটতে থাকে। তারপরে আসে সেই ২৯ আগস্ট। সেই রাতেই রুমী, জামী, শরীফ ইমাম কে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। এছাড়া একই রাতে ধরা পড়েন আজাদ, বদি, আলতাফ মাহমুদ সহ আরও অনেকে। পরদিন জামী আর তার বাবা ফিরে এলেও রুমীরা ফেরে না।
এরপর শুরু হয় এক অসহায় মায়ের আকুতি। জাহানারা ইমাম তাঁর ছেলেকে ফিরে পেতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁর ছেলে আর কোনোদিন ফিরে আসেনি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্মম অত্যাচারে শহীদ হয় রুমী।
‘৯০ এর দশকে স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার ও আল-বদরদের বিচারের দাবিতে যে আন্দোলন সূচিত হয়েছিল সেই আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। “একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি” গঠনেও তার ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামী তাদের দলের আমীর ঘোষণা করলে বাংলাদেশে জনবিক্ষোভের সূত্রপাত হয়। বিক্ষোভের অংশ হিসেবে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি ১০১ সদস্য বিশিষ্ট একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয়। সর্বসম্মতিক্রমে এর আহ্বায়ক নির্বাচিত হন জাহানারা ইমাম। এই কমিটি ১৯৯২ সালে ২৬ মার্চ ‘গণআদালত’-এর মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক বিচার অনুষ্ঠান করে। ১২ জন বিচারক সমন্বয়ে গঠিত গণআদালতের চেয়ারম্যান জাহানারা ইমাম গোলাম আযমের ১০টি অপরাধ মৃত্যুদন্ড-যোগ্য বলে ঘোষণা করেন। জাহানারা ইমাম গণআদালতের রায় কার্যকর করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান।
শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকলে ২ এপ্রিল ১৯৯৪ সালে চিকিৎসার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান ডেট্টয়েট হাসপাতালের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন জাহানারা ইমাম। দেশ ছাড়ার আগে জননী বলেছিলেন, “ওদের মৃত্যুঘন্টা বেজে গেছে। দেখিস, এবার ফিরে এলেই দুর্বার আন্দোলন গড়বো আমরা। দেশ জেগেছে, তরুনেরা ধরেছে হাল। আমার সন্তনেরা একাট্টা হয়েছে ‘দানবশক্তি’র বিরুদ্ধে। জয় আমাদের সুনিশ্চিত!” সেই ফিরে আসা আর হয়নি জননীর। ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭টায় মিশিগানের ডেট্টয়েট নগরীর সাইনাই হাসপাতালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ৬৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। ৪ জুলাই তার মৃতদেহ বাংলাদেশে আনা হয়। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সমন্বয় কমিটির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তার মৃতদেহ গ্রহণ করেন জাতীয় সংসদের তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। ৫ জুলাই সকালে জনগণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্যে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তার কফিন রাখা হয়। দুপুরে জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে জানাযা শেষে তাকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযোদ্ধা গোরস্থানে সমাহিত করা হয়। এ সময় মুক্তিযুদ্ধের আটজন সেক্টর কমান্ডার শহীদ জননীকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন।