কড়া নজর প্রতিবেদন ঃ
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে চলমান লকডাউনের সময়সীমা আবারো ৭ দিন বাড়ানো হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে থেকে জারি করা সরকারি এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘৩০ মে মধ্যরাত থেকে ৬ই জুন মধ্যরাত পর্যন্ত সব ধরণের বিধিনিষেধ জারি থাকার মেয়াদ বাড়ানো হলো’।
করোনাভাইরাস সংক্রমণের চলমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে কঠোর বিধিনিষেধের সময়সীমা বাড়ানোর এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বলে এতে জানানো হয়। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, আগের সব শর্ত এই নতুন সময়সীমাতেও কার্যকর থাকবে।
কাগজে-কলমে বিধিনিষেধ জারি থাকার কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু বাংলাদেশে বেশ অনেকদিন ধরে দোকানপাটসহ বিভিন্ন অফিসের কার্যক্রম চলছে। এক পর্যায়ে শহরের মধ্যে যানবাহন চালু করা হয়েছিল। এখন আন্তঃজেলা পর্যায়ের যানবাহনও চালু করা হয়েছে। গত ২৩শে মে দেয়া লকডাউন বর্ধিত করা ঘোষণাতেই বেশ কিছু শর্ত শিথিল করা হয়েছিল। সেসময় স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবং অর্ধেক আসন ফাঁকা রাখার শর্তে দূরপাল্লার গণপরিবহন চলাচল করার অনুমতি দেয়া হয়। সেখানে সরকারিভাবে পরিচালিত ট্রেনও চালু করার কথা বলা হয়। অভ্যন্তরীন বিমান আগে থেকেই চলছে। এছাড়া হোটেল-রেস্তোরায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে খাবার পরিবেশনের অনুমোদন আসে।
এর আগে, গত ২৩শে মে লকডাউনের সময়সীমা আরো এক সপ্তাহ বাড়িয়ে তা ৩০শে মে মধ্যরাত পর্যন্ত করা হয়। সে হিসেবে আজ মধ্যরাতে লকডাউন শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে সেটি এখন আরো এক সপ্তাহ বাড়লো।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ার কারণে গত ১৪ই এপ্রিল থেকে আবার কঠোর লকডাউন জারি করা হয়েছিল।
এদিকে, দেশে ঢিলেঢালা ভাবে লকডাউন চললেও উত্তরাঞ্চলীয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় আলাদাভাবে একটা লকডাউন পালন করছে স্থানীয় প্রশাসন। সেখানে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের হার ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে বেশি হওয়ার পর জেলাটিতে দেশের অন্য অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয় বলে প্রশাসন থেকে বলা হয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে সংক্রমণের হার কয়েকগুণ বেশি
এছাড়া সিলেট, কুমিল্লা, খুলনা, যশোর, দিনাজপুর এবং ঝিনাইদহ সহ বিভিন্ন সীমান্তবর্তী জেলায় সংক্রমণের বৃদ্ধির খবর পাওয়া যায়। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে কয়েকদিন ধরে করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিশেষ লকডাউনসহ নানা পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ- ভারত সীমান্তবর্তী এই জেলার স্থানীয় প্রশাসন। এই লকডাউন ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে কারণ এটি এমন পরিস্থিতিতে দেয়া হয়েছে যখন ওই জেলায় এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে করোনা সংক্রমণ পঞ্চাশ শতাংশেরও বেশি।
অথচ বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অন্যান্য এলাকার মতোই এই জেলাতেও করোনা সংক্রমণ এতো কম ছিলো যে সাধারণ মানুষের মধ্যে এর বিশেষ কোন গুরুত্বই ছিলো না। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টে যায় এবারের ঈদের পর যখন সংক্রমণের হার প্রায় ৭৫ শতাংশে উঠে যায়। সেখানকার স্কুল শিক্ষক রওনক আরা বলছেন এখন ঘরে ঘরে রোগী এবং পরিস্থিতি নিয়ে অনেকের মতো তিনিও উদ্বিগ্ন।
‘মানুষজন তেমন সচেতন ছিলো না প্রথম থেকেই। এখন ঘরে ঘরে করোনা রোগী কিন্তু কেউ বলছে না। বা জানেনা। যারা পরীক্ষা করছে তারা হয়তো জানতে পারছে বা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। যারা বাড়িতে ট্রিটমেন্ট নিচ্ছে তাদের অনেকে ঘুরে বেড়াচ্ছে অসচেতনভাবে। আর ঈদের সময় বাজার খুলে দেওয়ায় আরো বেশি ছড়িয়ে গেছে,’ বলেন তিনি।
সারাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের হার যখন আট থেকে দশ শতাংশ, তখন চাঁপাইনবাবগঞ্জে সংক্রমণের হার ৫০ শতাংশের বেশি
কর্তৃপক্ষের হিসেবে বুধবারও ওই জেলায় সংক্রমণের হার ছিলো ৬০ শতাংশের বেশি। বুধবার দেয়া তথ্য অনুযায়ী সর্বশেষ ২৭০ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ১৫৯ জনের পজিটিভ শনাক্ত হয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জে, যে জেলার তিন দিকে ভারতের সাথে সীমান্ত আছে বাংলাদেশের। জেলার পশ্চিমে পদ্মা নদী ও ভারতের মালদহ জেলা, উত্তরেও মালদহ জেলা এবং দক্ষিণে পদ্মা নদী ও মুর্শিদাবাদ জেলা।
বাস্তবতা হলো লকডাউন ঘোষণার পরেও ধারাবাহিকভাবে ৫০ শতাংশের বেশি সংক্রমণ শনাক্ত হচ্ছে বাংলাদেশের আমের রাজধানী হিসেবে পরিচিত এই জেলায়। সরকারি হিসেবে বছরে প্রায় তিন লাখ টন আম উৎপাদন হয় এবং প্রায় দশ হাজার কোটি টাকার আম বেচাকেনা হয় সেখানে। ফলে আমের মৌসুমের আগে থেকেই বাইরে থেকে এ ব্যবসার সাথে যুক্ত বিপুল সংখ্যক মানুষের আনাগোনা বেড়ে যায়, যা এবার শুরু হয়েছে ঈদের আগেই।
দুই সপ্তাহ আগে করোনা ভাইরাসের ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের অস্তিত্ব বাংলাদেশে প্রথম ধরা পড়েছিল যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে। ভারতের সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের বেশিরভাগ জেলায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এখন অন্য জেলাগুলোর চেয়ে বেশি। সম্প্রতি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় সংক্রমণের হার ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ায় বেশ নড়েচড়ে বসেছে সরকার। দিনাজপুরের হিলি বন্দর দিয়ে প্রতিদিন দেড়শ’ থেকে দুইশ ট্রাক ভারতে যাওয়া-আসা করে। এই পরিবহনের সাথে সম্পৃক্ত প্রতিদিন চারশো থেকে সাড়ে চারশো ড্রাইভার এবং হেলপার আসা করছে।
দিনাজপুরের সিভিল সার্জন আব্দুল কুদ্দুস বলেন, পণ্য পরিবহণের সাথে সম্পৃক্ত ড্রাইভার এবং হেলপারদের স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলার বিষয়টি নিশ্চিত করা হচ্ছে। গত এক সপ্তাহে যশোরে করোনা ভাইরাস শনাক্তের হার গড়ে ২০ শতাংশের মতো।
বিভিন্ন স্থল বন্দর দিয়ে ভারত থেকে অনেক বাংলাদেশি বৈধ পথে আসা যাওয়া করলেও অনেকে অবৈধভাবে সীমান্ত পেরিয়ে আসা-যাওয়া করছেন। যারা অবৈধ পথে আসা-যাওয়া করেন তাদের সবসময় ধরা যায় না। ফলে তাদের মাধ্যমে সংক্রমণ কতটা ছড়িয়ে যাচ্ছে সেটি নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে। ‘সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে ব্যাপক হারে করোনা ভাইরাসের পরীক্ষা করাতে হবে। কিন্তু সেটি হচ্ছে না। মানুষ আমাদের কাছে এসে টেস্ট করাবে – এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমাদের আগ্রহী হয়ে মানুষের কাছে গিয়ে টেস্ট করাতে হবে। একমাত্র টেস্টই পারে সংক্রমণ কমাতে, বলেন আব্দুল কুদ্দুস।’