
কড়া নজর প্রতিবেদন-
ভ্রাম্যমান আদালত ইটভাটা ভেঙ্গে দিচ্ছে । তার চার-পাঁচদিনের মধ্যে ঠিকঠাক করে মালিক পুনরায় চালু করছে। এই ভাঙ্গা-গড়ার (অপ)সংস্কৃতি লক্ষ করা যাচ্ছে এ বছরই প্রথম। অথচ গত মওসুমে যে ভাটায় অভিযান চালানো হয়েছে তা সত্যিকার অর্থে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এক বছরের ব্যবধানে উচ্ছেদের ধরণের আকাশ-পাতাল ফাঁরাক নিয়ে জনমনে প্রশ্ন ওঠেছে। জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে। আকারে-ইঙ্গিতে দুই পক্ষ পরস্পরকে দোষারোপ করলেও স্পষ্ট করে কেউ গণমাধ্যমকে কারণ বলছে না।
ফলে বর্তমান অবস্থায় গাজীপুর মহানগর ও সদর উপজেলার সিংহভাগ ইট ভাটায় এখন আগুন জ¦লছে। অথচ ইতোমধ্যে উচ্চ আদালত রাজধানীর আশপাশের জেলাগুলোতে ইটের ভাটা নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। ভাটা মালিকরা একত্রিত হয়ে আদালতে রিটের চেষ্টা করে। সাড়া না পেয়ে ‘অদৃশ্য শক্তি’র ভরসায় ইট তৈরি শুরু করে দিয়েছে। স্বল্প সময়ে অধিক মুনাফার কারণে সব এলাকার প্রভাবশালীরা জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ঝুঁকির তোয়াক্কা না করে প্রতিবছরই নতুন ভাটা দিচ্ছে।
যে প্রক্রিয়ায় ইটভাটা
ভাটা মালিকরা প্রথমে স্থানীয় কৃষি অফিস থেকে এক ফসলি জমির ( প্রকৃতপক্ষে ইট ভাটায় ব্যবহৃত জমি একেবারে বন্ধ্যা হয়ে যায়) ছাড়পত্র নেন। পরের কাজ এগিয়ে দেন ইউনিয়ন সহকারী ভূমি কর্মকর্তা। তিনি ওই জমির শিল্প জোত খুলে দেন। ইউ.পি চেয়ারম্যান ব্যবসার ছাড়পত্র দেন। জেলা প্রশাসক দেন ইট পোড়ানোর লাইসেন্স। পরিবেশ অধিদপ্তরে ছাড়পত্রের আবেদন দিয়েই মালিকরা ভাটা চালু করে দেন।
সরেজমিন ঃ ভাওয়াল মির্জাপুর
একেকটি ইট ভাটা অর্থ – বেলে-দোঁআশের কয়েক একর ফসলি জমি স্থায়ী পোড়ামাটিতে রূপান্তর। কিছু কয়লা সামনে স্তুপ করা – কিন্তু গনগনে আগুনে পুড়ছে ফলদ-গজারি বৃক্ষ ফালি ফালি করা টনে টনে কাঠ। চিমনি দিয়ে রাত-দিন নির্গত হচ্ছে সর্বনাশা ধোঁয়া, অস্বাস্থ্যকর-ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কর্মরত শতেক নারী-পুরুষ।
দুই কিলোমিটার এলাকায় যখন এক রকম শতাধিক ইট ভাটা, তখন – এক সময়ের চিনে বাদাম, মিস্টি আলু, গোল আলু, মরিচ, পেঁয়াজ , খিরাই , আখ ফসলের উর্বর জমিন পুরো চক এলাকা আজীবনের জন্য নিস্ফলা। আশপাশের গাছপালা , ঘর-বাড়িতে লালচে ধূলার স্তর। বাতাসে ভাসা ধোঁয়া-ধূলি গ্রামবাসীর মুখ-নাক নিয়ে অনবরত শাসযন্ত্রে ঢুকে পড়ছে। পরিনামে সর্দি-কাশি-শাসকষ্ট। রাত-দিন নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে দানবের মত ট্রাক-লরির যাতায়াত। খোবলা রাস্তাঘাট।
শতাধিক ভাটা থেকে কাঁচা টাকা যাচ্ছে ১০-১২ টি প্রভাবশালী পরিবারে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কয়েক শ’ পরিবার। বছরের পর বছর একই চেনা দৃশ্য। প্রতি বছর দু’চারটি করে ভাটা বাড়ছে-ফসলি জমি কমছে।
বুধবার বিনোদনবার
ইট ভাটায় উদয়াস্ত যারা খাটছে, তারা বুধবারের অপেক্ষায় থাকে। ভাওয়াল মির্জাপুর এলাকার যুগ যুগের রেওয়াজ বিদ্যালয়-মহাবিদ্যালয়ের সাপ্তাহিক ছুটির দিন বুধবার। সারাদেশেরই সম্ভবত একমাত্র ব্যতিক্রম। কারণ হচ্ছে ,অতি প্রাচীণ ও জমজমাট হাট। সপ্তাহের এই দিনে এত জনসমাগম হয় যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ভাটা শ্রমিকদেরও ছুটি ,অর্থপ্রাপ্তি ও বিনোদনের দিন বুধবার।
বহুরিয়া চালার কারবালা মাঠ থেকে পাইনশাইল,ডগরি,পিরুজালী ও সড়ক ঘাট মৌজায় গড়ে উঠা শতাধিক ইটাভাটায় জামালপুর,শেরপুর,ময়মনসিংহ,রংপুর,সিরাজগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা শ্রমিকরা কাজ করে। প্রতিটি ভাটায় গড়ে দুই শিফটে অন্ততঃ ৩০০ জন শ্রমিক কাজ করে। ভাটাসংলগ্ন সারি সারি খুপরি বানিয়ে শ্রমিকরা সেখানে বসবাস করে।
বুধবার সবাই সাপ্তাহিক মজুরি পায় বলে রাতে জেগে ওঠে চক এলাকা । স্থাণীয় প্রভাবশালীরা শ্রমিকদের ওই মজুরিতে ভাগ বসাতে অসুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা রেখেছে। বিশেষ করে বুধবার মেলা বসে মাদক ও দেহ প্রসারিনীদের। সন্ধ্যা নামলেই চড়া স্বরে গান ভেসে আসতে থাকে খুপরিগুলো থেকে। দালালরা প্রত্যেক নারীর কাছ থেকে অগ্রিম ১০০০ টাকা নিয়ে কলোনিগুলোতে রেখে আসে। শ্রমিকদের ভাষায় এরা ‘মাটির ফুল’ , দালালরা বলে ‘সখি’। পাইনশাইল উত্তরের চক এলাকার ভাটাগুলোতে ‘সখি’ সরবরাহের নিয়ন্ত্রণ করে ফলিঙ্গা হারুন,কসাই হারুন, দেলোয়ার ওরফে দেলু, মোটা রিপন, কাশেম মেম্বার । বহুরিয়া চালা ও পাইনশাইল দক্ষিণের চক , জয়নাল, ফজলু নিয়ন্ত্রণ করে । আমজাদ, রানা,লম্ফু রফিক, কানা বাবুল ইট-ভাটাকেন্দ্রিক ইয়াবা ও গাঁজার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে বলে জানান এলাকাবাসী। এর আগে বিদেশি মদ ও বিয়ারসহ ইট-ভাটা মালিক ঘোড়া আশরাফুল পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিল। ইট ভাটার বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে পাশর্বর্তী গ্রামগুলোতে। এ কারণে ছেলে-মেয়ে নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন অভিভাবকেরা।