কড়ানজর প্রতিবেদকঃ
জিয়া পরিবারের শাসন চিরস্থায়ী করার মানসে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। চিরস্থায়ী ক্ষমতার পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়ায় আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা। তাই পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে সুপরিকল্পিতভাবে গ্রেনেড হামলা করে নিশ্চিহ্ন করতে চায় প্রধান ও একমাত্র শত্রুকে। তখন সরকারে ছিল সেনাগর্ভে জন্ম জগাখিচুরি দল বিএনপি এবং স্বাধীনতাবিরোধী পাকিদের দোসর জামায়াতে ইসলামী। টার্গেট বাংলাদেশের স্থপতির কন্যা ও তাঁর দলের কেন্দ্রীয় সকল নেতা। ৭৫’র ১৫ আগস্টের অসমাপ্ত পর্ব সমাপ্ত করাই টার্গেট। সরকার প্রধান খালেদা জিয়ার সম্মতিতে তাঁর বথে যাওয়া জ্যেষ্ঠ সন্তানের তত্ত্বাবধানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীসহ একাধিক মন্ত্রী, সংসদ, রাষ্ট্রীয় সামরিক-বেসামরিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান, আফগানফেরত জঙ্গি সমন্বয়ে সামরিক বাহিনীতে ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেড নিয়ে হামলার পর বঙ্গবন্ধুকন্যার বেঁচে থাকার কোন সুযোগই ছিল না। নিতান্তই ভাগ্যগুনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রাণ রক্ষা পায়।
গ্রেনেড হামলায় নিহতের সংখ্যা (২৪জন) দিয়ে সেদিন ভয়াবহতা সম্পর্কে ধারনা দেওয়া যাবেনা। সেই সন্ধ্যায় পুরো বঙ্গবন্ধু এভিনিউ জুড়ে আহত-নিহত নারী-পুরুষের দেহ বিছিয়ে আছে। কে আহত কে নিহত বুঝার উপায় নাই। ভয়ার্ত নারী-পুরুষের চিৎকার, আহতদের গোঙানির শব্দ, হাজারো জুতা-সেন্ডেল পড়ে আছে। এর মধ্যে মুহুর্মুহু গুলি। পুলিশের লাঠি-চার্জ, কাঁদানো গ্যাসের সেল নিক্ষেপ। উদ্ধারে এগিয়ে আসতে পারছে না মানুষ।
কী ঘটেছিল সেদিন?
শেখ হাসিনা তখন আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সন্ত্রাস-দুর্নীতিবিরোধী কর্মকান্ডের প্রতিবাদে সেদিন বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল। একটি ট্রাকে অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করে সমাবেশ চলছিল। সেদিনের অভিশপ্ত ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শেখ হাসিনা বিকেল পাঁচটার দিকে সমাবেশস্থলে পৌছান। বুলেটপ্রুভ গাড়ি থেকে নেমে নিরাপত্তাকর্মী ও দলীয় নেতাকর্মী পরিবেষ্টিক অবস্থায় তিনি অস্থায়ী মঞ্চে ওঠেন।
সমাবেশে শেখ হাসিনা বক্তব্য করেন ৫টা ২ মিনিটে। ২০ মিনিটের বক্তব্য শেষে ৫টা ২২ মিনিটে ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে হাতে থাকা কাগজ ভাঁজ করতে করতে মা্ইক ছেড়ে পিছিয়ে যাচ্ছিলেন। ঠিক সেই সময় একজন সাংবাদিক তাকে ছবির জন্য একটি পোজ দিতে অনুরোধ করেন। তখন শেখ হাসিনা আবারও ঘুরে দাঁড়ান। আর ঠিক সেই মুহুর্তেই দক্ষিণ দিক তাঁকে লক্ষ্যে করে একটি গ্রেনেড ছুঁড়ে মারা হয়। গ্রেনেডটি ট্রাকের বাঁ পাশে পড়ে বিস্ফোরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শেখ হাসিনা ট্রাকের ওপর বসে পড়েন। তার সঙ্গে থাকা অন্য নেতারা এ সময় মানবঢাল তৈরি করে তাকে ঘিরে ফেলেন। প্রথম গ্রেনেড হামলার মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ট্রাক লক্ষ্যে করে একই দিক থেকে পর পর আরও দুটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। বিকাল ৫টা ২২ মিনিট থেকে এক-দেড় মিনিটের ব্যবধানে ১৩টি বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি, ঢাকার প্রয়াত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ও সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, নিরাপত্তা কর্মকর্তা মেজর (অব.) শোয়েব, ব্যক্তিগত স্টাফ নজীব আহমেদসহ দেহরক্ষীরা শেখ হাসিনাকে ধরে ট্রাক থেকে দ্রুত নামিয়ে তার মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়িতে তুলে দেন।
সিনিয়র ফটোসাংবাদিক এস এম গোর্কি সেদিন শেখ হাসিনার ভালো ছবি পাননি বলে বলে তাকে আবারও পোজ দেবার অনুরোধ করেছিলেন। তার অনুরোধে সাড়া দিয়েই বঙ্গবন্ধুকন্যা ফের ডায়াসে ঘুরে দাঁড়ান। এ বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর একাধিক বক্তব্যে নিজেই উল্লেখ করেছেন। ২০০৯ সালে একটি আনুষ্ঠানিক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘নেতাকর্মীরা মানবঢাল তৈরি করে আমাকে বাঁচিয়েছেন। কিন্তু গ্রেনেড গায়ে লাগলে কী হতো বলা যায়না।’ তিনি ফটোসাংবাদিক এস এম গোর্কির নাম উল্লেখ করে বলেন, ‘গোর্কি মনে হয় ভালো ছবি পায় নাই। আমি বক্তব্য শেষ করে যাওয়ার জন্য ধুরে এক পা বাড়িয়েছি। তখন গোর্কি আমাকে বলে, ‘আপা, ছবি পাই নাই, একটু দাঁড়ান।’ আমি আবারও ঘুড়ে দাঁড়াই। আর সঙ্গে সঙ্গে বিকট শব্দ। গ্রেনেড যে জায়গায় পড়েছে সেদিক দিয়েই আমার নামার কথা ছিল। কিন্তু ছবি তোলার সুযোগ দিতে ঘুরে দাঁড়ানোয় আমি আবারও ডায়াসে দাঁড়াই।
এস এম গোর্কি পরবর্তীতে বলেন, ‘ভালো ছবি না পাওয়ায় আওয়ামী লীগ সভাপতি ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতাকে অনুরোধ জানাই। তিনিও সাড়া দেন। পরক্ষণেই সেই নারকীয় গ্রেনেড হামলা শুরু হয়।