মুক্তিযুদ্ধের স্মারক-ভার্স্কয ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’তে ১৯ মার্চ’ ৭১-এ প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রামে শহীদদের নাম নেই। এতে মুক্তিযুদ্ধে ১৬ বেঙ্গল রেজিমেন্টের নিহত ২০৭ সেনা সদস্যদের নাম উৎকীর্ণ আছে। ঢাকা-ময়মনসিংহ ও গাজীপুর-টাঙ্গাইল মহাসড়ক দুইটির সংযোগস্থল চান্দনা চৌরাস্তায় ১৯৭৩ সালে ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’ স্থাপন করা হয়। লুঙি পরা , ডান হাতে গ্রেনেড , বাম হাতে বন্দুক, খালি গা-পা ,পেশীবহুল শরীর নিয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন অতন্দ্র প্রহরী মুক্তিযোদ্ধা।চান্দনায় ১৯ মার্চ’ ৭১-এ প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রামে শহীদ হুরমত ও কানু বীর এবং একই দিন জয়দেবপুরে নিহত হন নিয়ামত ও মনু খলিফা।বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ‘ জয়দেবপুর ও ১৯ মার্চ ১৯৭১ ’ গৌরবগাঁথা অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হওয়ার ৭ দিন আগে জয়দেবপুরবাসী পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। পাকি সেনা কর্মকর্তা জাহানজেব জয়দেবপুরের রাজবাড়িতে দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেনাদের নিরস্ত্র করতে আসার খবরে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে কৃষক-শ্রমিক-জনতা। দুপুরে জাহানজেব ঢাকা ফেরার পথে হাজারো জনতা প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলে জয়দেবপুর শহরের রেল ক্রসিঙ ঘিরে। পাকিদের গুলিবর্ষনের জবাব দেন স্থানীয়রা গাদা বন্দুক ও কেড়ে নেওয়া চাইনিজ রাইফেল দিয়ে। এখানে কিশোর নিয়ামত ও মনু খলিফা শহীদ হন। পথিমধ্যে কয়েকটি ছোট ছোট ব্যারিকেড দেয় জনতা। জাহানজেবের রাজধানীমুখি কনভয় রুখতে জনতা দ্বিতীয় বড় ব্যারিকেড গড়ে চান্দনা চৌরাস্তায়। এখানে ফুটবল খেলোয়ার হুরমত ও কানু বীর শহীদ হন।
মুক্তিযুদ্ধে ১৯ মার্চের প্রতিরোধ এত সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে যে – সারাদেশে শ্লোগান ওঠে ‘জয়দেবপুরের পথ ধর, বাংলাদেশ ¯স্বাধীন কর।’
সেই প্রতিরোধ যুদ্ধের পুরোধা ছিলেন আ.ক.ম. মোজাম্মেল হক। তিনি পর পর দ্বিতীয় বারের মত শেখ হাসিনা সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী। ১৯ মার্চের ¯স্বীকৃতিস্বরূপ আ.ক. ম. মোজাম্মেল হক চলতি বছর রাষ্ট্রের র্সবাধিক র্মযাদাবান রাষ্ট্রীয় পুরস্কার স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এখনও অবশ্য প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধের রাষ্ট্রীয় ¯স্বীকৃতি মিলেনি এবং ১৯ মার্চের স্মারক ভার্স্কয নির্মিত হয়নি। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী এক সাক্ষাৎকারে ‘কড়া নজর’কে জানান, মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পূর্তিতে ১৯ মার্চ ১৯৭১’র রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মিলবে।
এর আগেই ১৯ মার্চ ৭১’র স্মারক ভাস্কর্য জয়দেবপুরে (প্রথম প্রতিরোধস্থলে) নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন একাধিক সংগঠন, পেশাজীবী, সাংস্কৃতিক সংগঠনের নের্তৃবৃন্দ।
বক্তৃতা ও বইয়ে ১৯ মার্চের চেতনায় জাগ্রত চৌরঙ্গী নির্মিত বলে দাবি করা হলেও বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে। সামরিক কর্মকর্তাদের তত্তাবধানে তাদের ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সহায়তায় ভাস্কর্যটি নির্মাণ করে চান্দনা চৌরাস্তায় স্থাপন করা হয়। তৎকালীন জয়দেবপুরে বেঙ্গল রেজিমেন্টের দায়িত্বপালনকারী কর্মকর্তা আমীন আহম্মেদ চৌধুরী (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল হিসাবে অবসরগ্রহন করেন) তার ‘ ১৯৭১ ও আমার সামরিক জীবন’ বইতে বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন।
ভিত বা বেদিসহ জাগ্রত চৌধুরীর উচ্চতা ৪২ ফুট ২ ইঞ্চি। ২৪ ফুট ৫ ইঞ্চি বেদির উপর মূল ভাস্কর্যের দৈর্ঘ্য ১৭ ফুট ৭ ইঞ্চি। কনক্রিট, গ্রে সিমেন্ট, হোয়াইট সিমেন্ট দিয়ে ঢালায় করে নির্মিত করা হয়। ভাস্কর্যটিতে ১৬ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৩ নম্বর সেক্টরের ১০০ জন ও ১১ নং সেক্টরের ১০৭ জন মোট ২০৭ জন শহীদ সেনার নাম শ্বেতপাথরে উৎকীর্ণ আছে। স্বাধীনতার পরের বছর তৎকালীন ঢাকা আর্ট কলেজের অধ্যক্ষ আবদুর রাজ্জাক সহযোগী হামিদুজ্জামান খানকে নিয়ে ভাস্কর্য নির্মাণ কাজ শুরু করেন। ৭৩ সালে এর কাজ শেষ হয়।