কড়ানজর প্রতিবেদকঃ
আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেত্রী হেলেনা জাহাঙ্গীরের মালিকানাধীন জয়যাত্রা আইপি টিভি ও জয়যাত্রা ফাউন্ডেশনের ভবনে র্যাবের অভিযান শেষ হয়েছে। বৃহস্পতিবার(২৯জুলাই) গভীর রাতে রাজধানীর মিরপুরে অবস্থিত ওই ভবনে র্যাব অভিযান শুরু করে।
শুক্রবার (৩০জুলাই) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল এ এম আজাদ জানান, টিভি চ্যানেলটির অনুমোদন থাকার কোনো কাগজপত্র তাঁরা পাননি। এ নিয়ে যাচাই–বাছাইয়ের কাজ চলমান। বিকেল চারটার বিস্তারিত জানাবে র্যাব।
বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সোয়া ১২টার দিকে গুলশানের বাসা থেকে হেলেনা জাহাঙ্গীরকে আটক করে র্যাবের সদর দপ্তরে নেওয়া হয়। এর আগে র্যাবের একটি দল রাত আটটার দিকে রাজধানীর গুলশান ২–এর ৩৬ নম্বর সড়কে হেলেনা জাহাঙ্গীরের বাসায় অভিযান শুরু করে। প্রায় সোয়া চার ঘন্টা র্যাবের অভিযান চলে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার আল মঈন গণমাধ্যমকে বলেন, হেলেনা জাহাঙ্গীরের বাসা থেকে কয়েক বোতল মদ, বিদেশি মুদ্রা, বন্য প্রাণীর চামড়া, ক্যাসিনোর সরঞ্জাম ও ওয়াকিটকি সেট উদ্ধার করা হয়েছে। এ ব্যাপারে হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আইনে মামলা করা হবে।
এর আগে গত রোববার আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটির সদস্যপদ থেকে হেলেনা জাহাঙ্গীরকে অব্যাহতি দিয়ে আনুষ্ঠানিক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। বিজ্ঞপ্তিতে উপকমিটির সদস্যসচিব ও আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক মেহের আফরোজ সই করেন। এতে বলা হয়, হেলেনা জাহাঙ্গীর আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটির সদস্য ছিলেন। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত তাঁর সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড সংগঠনের নীতিবহির্ভূত হওয়ায় আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটির সদস্যপদ হতে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
কে এই হেলেনা জাহাঙ্গীর?
বেশ কয়েক বছর ধরেই হেলেনা জাহাঙ্গীর নামটি বহুল চর্চিত নামের মধ্যে একটি। তিনি একাধারে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী এবং নারী উদ্যোক্তা। সম্প্রতি আবারও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে তার নাম। “আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ” নামের একটি সংগঠনের পোস্টারের সূত্র ধরে তিনি আবারও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছেন। ভুঁইফোড় এ সংগঠনের সভাপতি হিসেবে তার নাম এসেছে। যদিও ওই পদ এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেননি বলেই দাবি তার। চলুন জেনে নিই তার আদ্যপান্ত-
রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় হেলেনার জন্ম ১৯৭৪ সালের ২৯ আগস্ট। তার বাবা মরহুম আবদুল হক শরীফ ছিলেন জাহাজের ক্যাপ্টেন। ঢাকায় জন্ম নিলেও তিনি বড় হন বন্দরনগরী চট্টগ্রামের হালিশহরের মাদারবাড়ী সদরঘাট এলাকায়। পড়াশোনা করেছন স্থানীয় কৃষ্ণচূড়া স্কুলে। চাকরিসূত্রে তার বাবা রাশিয়ায় চলে গেলে মায়ের সঙ্গে গ্রামে ফিরে যান হেলেনা।
১৯৯০ সালে ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলমের সাথে ৮ম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বিয়ে হয়ে যায় হেলেনার। বিয়ের পর হেলেনার নামের সঙ্গে যুক্ত হয় জাহাঙ্গীর। স্বামীর সংসারে হেলেনা জাহাঙ্গীর পড়াশোনা অব্যাহত রাখেন ও স্নাতক সম্পন্ন করেন। পড়াশোনা শেষ করে হেলেনা জাহাঙ্গীর শুরুতে চাকরির চেষ্টা করতে বিভিন্ন জায়গায় ইন্টারভিউও দিলেও এক পর্যায়ে উদ্যোক্তা হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর শুরু করেন তার উদ্যোক্তা জীবন।
বিয়ের ছয় বছর পর ১৯৯৬ সালে রাজধানীর মিরপুর-১১ এলাকায় একটি ভবনের দুটি ফ্লোর নিয়ে তিনি প্রিন্টিং ও অ্যামব্রয়ডারি ব্যবসা শুরু করেন। এর মাধ্যমে পোশাক শিল্পের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ হিসেবে বিভিন্ন ধরনের পণ্যের জন্য লোগো ও স্টিকার প্রিন্ট করা হয়। নিট কনসার্ন প্রিন্টিং ইউনিট লিমিটেড দিয়ে শুরু করে জয়যাত্রা গ্রুপের আওতায় একে একে হেলেনা গড়ে তোলেন জয় অটো গার্মেন্টস লিমিটেড, জেসি এমব্রয়ডারি অ্যান্ড প্রিন্টিং এবং হুমায়রা স্টিকার লিমিটেড। সবগুলো প্রতিষ্ঠানেরই ব্যবস্থাপনা পরিচালক তিনি। সব মিলিয়ে ১২ হাজার কর্মী কাজ করছেন তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে।
ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) সদস্যপদ পাওয়ার এক মাসের মাথায় নির্বাচনে নেমে ও পরিচালক নির্বাচিত হয়ে আলোচনায় চলে আসেন হেলেনা জাহাঙ্গীর। পোশাক শিল্প মালিকদের দুটি সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএরও সক্রিয় সদস্য তিনি। জয়যাত্রা নামে একটি স্যাটেলাইট টেলিভিশনেরও মালিক তিনি। এছাড়া, রোটারি ক্লাবের একজন ডোনার হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পুরস্কারও নিয়েছেন তিনি।
এভাবেই ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তা হিসেবে অল্প সময়ের মধ্যে হেলেনা জাহাঙ্গীরের উত্থান হয়েছে।
রাজনৈতিক অঙ্গনেও হেলেনার দাপুটে উত্থান ও পদচারণা রয়েছে। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য ছিলেন। সাম্প্রতিক ঘটনার পর তাকে ওই কমিটি থেকে বাদ দেয়া হয়েছে বলে জানা যায়। তবে হেলেনা জাহাঙ্গীর জানান, তাকে এ ব্যাপারে কোনো আনুষ্ঠানিক চিঠি বা নোটিশ দেয়া হয়নি। এছাড়া, তিনি কুমিল্লা জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তিনি কয়েকটি বিদেশযাত্রার সফরসঙ্গী হয়েছিলেন বলেও জানা যায়।
বর্তমানে আওয়ামী রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হলেও এর আগে তার জাতীয় পার্টিতে এবং তারও আগে বিএনপির রাজনীতিতে সংশ্লিষ্টতার খবর পাওয়া যায়। গণমাধ্যমে ওই দুটি দলের প্রধান খালেদা জিয়া ও হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের সঙ্গে ছবিও প্রকাশিত হয়েছে।
প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ২০১৫ সালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচন করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন হেলেনা জাহাঙ্গীর। যদিও পরে তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। নির্বাচনের সময়ে কোনো রাজনৈতিক দলের অংশ না হয়ে স্বতন্ত্র রাজনীতি করার আগ্রহের কথা জানিয়েছিলেন তিনি।
শুধু রাজনৈতিকভাবেই নয়, বিভিন্ন সামাজিক ও জনকল্যাণমুলক সংগঠনগুলোর সঙ্গেও হেলেনা জাহাঙ্গীরের সম্পৃক্ততা রয়েছে। তিনি প্রায় এক ডজন সামাজিক সংগঠনের নেতৃস্থানীয় দায়িত্বে রয়েছেন। গুলশান ক্লাব, গুলশান নর্থ ক্লাব, বারিধারা ক্লাব, কুমিল্লা ক্লাব, গলফ ক্লাব, গুলশান অল কমিউনিটি ক্লাব, বিজিএমইএ অ্যাপারেল ক্লাব, বোট ক্লাব, গুলশান লেডিস ক্লাব, উত্তরা লেডিস ক্লাব, গুলশান ক্যাপিটাল ক্লাব, গুলশান সোসাইটি, বনানী সোসাইটি, গুলশান জগার্স সোসাইটি ও গুলশান হেলথ ক্লাবের সঙ্গে হেলেনা জাহাঙ্গীরের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।