কড়া নজর প্রতিবেদন-
উচ্চ আদালতের নির্দেশ অমান্য করে গাজীপুর সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়ন এলাকার বিভিন্ন ইটভাটায় আগুন দিয়ে ইট পোড়ানো কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পরিবেশ দূষণ রোধে ঢাকার আশপাশের সব ইটভাটা ১১ নভেম্বরের মধ্যে বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। গত ২৬ নভেম্বর হাইকোর্টের বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
হাইকোর্টের আদেশের পরও ইট ভাটা পুরোদমে চালুর প্রক্রিয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন পরিবেশবিদ ও এলাকাবাসি। অথচ নির্বিকার এটা দেখভাল করার দায়িত্বপালনকারী প্রতিষ্ঠান পরিবেশ অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের গাজীপুর জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মোঃ আঃ সালাম সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে জানান , তিনি হাইকোর্টের নির্দেশনা সম্পর্কে অবগত নন। পরে এ সংক্রান্ত প্রকাশিত সংবাদের কার্টিং দেখানো হলে তিনি বলেন ‘এ বিষয়ে কোন চিঠি তিনি পাননি ’ ।
রোববার বিকেলে তার কার্যালয়ে এ বিষয়ে সংবাদকর্মীদের সঙ্গে কোন কথা বলতে চাননি। কড়া নজর তার মুঠোফোনে কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। পরে ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়ে কথা বলার অনুরোধ করার পর তিনি মুঠোফোন বন্ধ করে দেন।
(গাজীপুর সদর উপজেলার পাইনশাইল মৌজাস্থিত ইটাভাটাগুলোর চিত্র গুগল থেকে নেয়া ( আংশিক))
উচ্চ আদালতের আদেশে বলা হয় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও গাজীপুরের অবৈধ ইটভাটাগুলো ১৫ দিনের মধ্যে বন্ধ করতে হবে। এসব ইটভাটার বিরুদ্ধে প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনারও নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্টের এই বেঞ্চ।
রোববার সরেজমিনে দেখা যায়, গাজীপুর সদর উপজেলার মির্জাপুর,পাইনশাইল,আঙ্গুটিয়াচালা মৌজায় জনবসতি পূর্ণ এলাকার আধা থেকে এক কিলোমিটার এলাকার মধ্যে , কৃষি জমির উপর শতাধিক ইটা ভাটার চল্লিশটিতে মাটি পোড়ানো শুরু হয়েছে। বাকিগুলোতেও ইট তৈরির প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে। এর মধ্যে গতবছর ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে জরিমানা আদায় ও স্থাপনা ধ্বংস করা ভাটাও রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে , গাজীপুরের প্রায় ৮৫ ভাগ ইটভাটাই অবৈধ। ট্রেড লাইসেন্স, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র, জেলা প্রশাসকের অনুমোদন ছাড়াই ভাটাগুলো চালাচ্ছে স্থাণীয় প্রভাবশালীরা। প্রতিবছর পার্শ্ববর্তী সরকারি বনের কয়েক হাজার টন কাঠ পুড়ছে ভাটাগুলোতে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সিটি করপোরেশন এলাকার ১৭৩টি ভাটার সবগুলোই অবৈধ। এ ছাড়া শ্রীপুর উপজেলার ২২টি ভাটার মধ্যে ১২টি, কালিয়াকৈরের ৪১টির মধ্যে ২২টি, কাপাসিয়ায় ৩৪টি ভাটার ২৮টি, কালীগঞ্জে ২২টির মধ্যে ১৮টি অবৈধ।
আর সদর উপজেলায় ইটভাটার সংখ্যা সরকারি হিসাবে ৬০টি। বাস্তবে এর দ্বিগুণেরও বেশি ইটভাটা দৃশ্যমান। মির্জাপুর তুরাগ ও শাখা নদীর ওপর ব্রিজে দাড়িয়ে শতাধিক ইট ভাটার চিমনি চোখে পড়ে।
কার আশ্বাসে হতাশ ভাটা মালিকরা হঠাৎ বেপরোয়া !
গত বছর ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে বেশ কয়েকটি অবৈধ ইট ভাটা মালিককে জরিমানা করা হয়। এ ছাড়া পানির তোড়ে কাঁচা ইট গলিয়ে ফেলা ও ভাটার আগুন নিভিয়ে দেন জেলা প্রশাসন। এ কারণে এ বছর মৌসুমের শুরুতে মালিকদের মধ্যে ভাটা চালু নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্ধে ভোগতে দেখা যায়। অধিকাংশ মালিকদের মধ্যে হতাশা কাজ করছিল।
এর উপর ‘মরার উপর খরার ঘা’ হিসাবে আসে উচ্চ আদালতের আদেশ। কিন্তু গত এক সপ্তাহে যাবতীয় হতাশা কাটিয়ে ভাটামালিকরা পূর্ণ উদ্যমে ভাটা তৈরির কাজ শুরু করে।
প্রশ্ন উঠছে- কার বা কাদের আশ্বাসে মোনাফা লোভী চক্র পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের বারোটা বাজিয়ে ভাটায় আগুন দিচ্ছে ! এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে একজন জন প্রতিনিধি ও খোদ পরিবেশ অধিদপ্তরের অসাধু কর্মকর্তার নাম ওঠে এসেছে।
এ ক্ষেত্রে গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোঃ আঃ সালাম সরকারের ভূমিকা প্রায় নগ্ন। রোববার তাঁর কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে কড়া নজরের এক সংবাদকর্মী ‘ অবৈধ ইট ভাটার সংখ্যা’ জানতে চাইলে তিনি ঘড়িমসি করেন। তিনি বলেন ‘ তালিকা তৈরি হয়নি’। তিনি ওই সংবাদকর্মীকে ৭ দিন পরে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন।
উচ্চ আদালতের নির্দেশনার ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বিরক্তির সুরে বলেন, ‘ আদেশ আমি পাইনি’। ভাবখানা এমন যেন ‘ উচ্চ আদালতের দায় – তাদের আদেশের কপি প্রত্যেক দপ্তরে পৌঁছে দেওয়ার ? ’।
এ ছাড়া মির্জাপুর বাজারের বেশ কয়েকজন দায়িত্বশীল নাগরিক অভিযোগ করেন, মোঃ আঃ সালাম সরকার ইট তৈরির মৌসুমে নিয়মিত যাতায়াত করেন ভাটা মালিকের গাড়িতে ও আতিথিয়তা গ্রহন করেন।
নদীর বুকে সরকারি টাকায় রাস্তা !
ক্ষমতার অপব্যবহার কাহাতক হতে পারে ! – অনেকের কল্পনাকে হার মানাবে ভাওয়াল মির্জাপুরের প্রভাবশালীদের কান্ড কারখানা দেখলে। নিজের ইট ভাটায় মাটি ও ইট পরিবহনের জন্য নদীর বুক চিরে সরকারি বরাদ্দ থেকে ইটের সলিঙ (সড়ক) নির্মাণ করে নিয়েছেন। বর্ষায় সড়কের উপর ৪/৫ফুট পরিমান পলি জমে। ভাটা তৈরির মৌসুমে মাটি কেটে নিজের ভাটায় নিয়ে সড়ক বের করেন। উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মোশাররফ হোসেন দুলাল ইউপি চেয়ারম্যান থাকার সময় সড়কটি নির্মাণ করেন। সম্প্রতি তিনি মাটা কাটা শুরু করলে সহকারী কমিশনারের (ভূমি) নির্দেশে মির্জাপুর ভূমি কার্যালয়ের সহকারী ভূমি কর্মকর্তা আবদুল আলীম বাঁধা প্রদান করেন।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তুরাগ নদ ও নালের প্রায় তিন একর জমি দখল করে ইটের ভাটা নির্মাণ করেছেন বলে মির্জাপুরের ভূমি অফিসের সাবেক সহকারী ভূমি কর্মকর্তা লুৎফর রহমান সদরের সহকারী কমিশনারের (ভূমি) দপ্তরে লিখিত প্রতিবেদন পাঠিয়েছিলেন।